শহীদনূর আহমেদ, দিরাই থেকে ফিরে::
মসজিদ ফান্ডের টাকা নিয়ে দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব। যা গড়ায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। এতে নারীসহ নিহত হন দুই জন ও আহত হয় অর্ধশত। জোড়া খুনের ঘটনায় প্রতিপক্ষের ভয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামছাড়া অর্ধশতাধিক পরিবারের সদস্যরা।
এদিকে প্রতিশোধ নিতে প্রতিপক্ষের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে নিহতের স্বজনদের বিরুদ্ধে। বলছিলাম দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের জাহানপুর গ্রামের গোলাপ ও আকবর আলী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ, খুন ও পরবর্তিতে বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের কথা। এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কে রয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। গ্রামে স্থিতিশীলতা ফেরাতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, জাহানপুর গ্রামের গোলাপ মিয়া ও আকবর আলী গোষ্ঠীর মধ্যে মসজিদের ফান্ড পরিচালনা, খেয়ানৌকা পারাপার ও এলাকাভিত্তিক আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলছিল। সম্প্রতি মসজিদের ফান্ড নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র গ্রামে তৈরি হয় আরেক মসজিদ। মসজিদ ফান্ডের টাকার সৃষ্ট দ্বন্দ্ব স্থায়ী বিরোধে রূপ নেয়। বিনষ্ট হয় অপরাপর গোষ্ঠীর মধ্যে সুসম্পর্ক।
গত ২২ সেপ্টেম্বর (সোমবার) সকাল ১১টার দিকে খেয়ানৌকা পারাপারকে কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায়। প্রথমে কথাকাটাকাটি, এরপর তা দ্রুতই দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। সংঘর্ষে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের অনেককেই সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনার এক সপ্তাহ পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৩ বছর বয়সী সাবাজ মিয়া ও ৪৫ বছর বয়সী সরলা বিবি মৃত্যুবরণ করেন। যা এলাকায় নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দেয়।
সংঘর্ষের ঘটনায় আহত পক্ষের সাক্কল মিয়া (৪৬) বাদী হয়ে গোলাপ মিয়াকে (৪৫) প্রধান আসামি করে মোট ৬০ জনের বিরুদ্ধে দিরাই থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এজাহারে ৪০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, বাকি ২০ জন অজ্ঞাতনামা। নিহতের খবর শুনে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান গোলাপ গোষ্ঠীর পুরুষ সদস্যরা। এছাড়া নিরাপত্তা ও প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে গ্রামছাড়া অর্ধশত পরিবারের নারী ও শিশুরা।
স্থানীয়রা জানান, স্বজন হত্যার বদলা নিতে ফুঁসে উঠে আকবর আলী পক্ষের লোকজন। সংঘবদ্ধভাবে চালানো হয় হামলা। অন্তত ৩০টি ঘর ভাঙচুর, আসবাবপত্র ও গবাদি পশু লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে।
রবিবার সরেজমিনে জাহানপুর গ্রামে লুটপাট ও ঘরবাড়ি ভাঙচুরের সত্যতা পাওয়া যায়। আধাপাকা কংক্রিটের দেয়াল ভারি হাতুড়ি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। চাল থেকে খুলে নেয়া হয়েছে টিন, কাঠসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। টিন সেডের ঘরগুলোর অস্তিত্ব রাখা হয়নি। বাঁশ, কাঠ, টিনসহ আসবাবপত্র লুট করে নেয়া হয়েছে। বিধ্বস্ত ঘরগুলো খালি ভিটেতে পড়ে রয়েছে। প্রতিপক্ষের আমন জমির ধানগাছ গরু দিয়ে বিনষ্ট করা হচ্ছে।
লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত আত্মগোপনে থাকা সিদ্দিক মিয়া বলেন, আমাদের প্রায় ৩৫টি ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হইছে। ঘরের কোনো চিহ্নই আর রাখে নাই।
বাড়িছাড়া মরিয়ম বেগম বলেন, প্রতিপক্ষের লোকেরা আমার ঘর ভাঙচুর করে ২ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, ১৫টি গরু ও নগদ ২ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। আমরা এখন মানুষের বাড়িতে দিন কাটাচ্ছি। সহিংসতার প্রভাবে নতুন করে দেখা দিয়েছে কৃষি সংকট। গ্রামছাড়া পরিবারগুলোর প্রায় ১০০ একরের মতো আবাদি জমি রয়েছে, যেগুলোর চাষাবাদ আগামী মৌসুমে বন্ধ থাকার আশঙ্কা করছেন গ্রামছাড়া কৃষকরা। ফলে এই পরিবারগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকেও চরম বিপদের মুখে পড়েছে।
জাহানপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক সুলতান বলেন, আমাদের প্রায় ১০০ একর জমিন আছে, এখন চাষের মৌসুম কিন্তু বাড়িঘরে না গেলে জমিন পতিত থাকবে।
দিরাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক জানান, ওইদিন সংঘর্ষের পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বর্তমানে তদন্ত চলমান রয়েছে।
এদিকে, সংঘর্ষের পর গোলাপ মিয়ার অনুসারীদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। মৃত সাবাজ মিয়ার ছেলে আনজু মিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে এই হামলার অভিযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্তরা। এছাড়া ভয়ে গ্রামছাড়া পরিবারগুলোর দাবি, প্রতিনিয়ত হুমকি ও প্রতিশোধমূলক হামলার ভয়ে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বর্তমানে নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ প্রায় অর্ধশত পরিবার গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন এলাকায়।
অপরদিকে নিহতদের স্বজনদের দাবি- প্রতিপক্ষরা নিজেদের জিনিসপত্র নিজেরাই নিয়ে এলাকা থেকে পালিয়েছে। নিহত শাবাজ মিয়ার ছেলে আনজু মিয়া এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। আকবর গোষ্ঠীর অন্যতম ব্যক্তি ফিরোজ মিয়া বলেন, গোলাপ বাহিনী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা মসজিদের টাকা আত্মসাৎ করেছে। দীর্ঘদিন অত্যাচারিত হয়ে আমরা বাধ্য হয়ে প্রতিবাদ করি। তাই তারা সংঘবদ্ধভাবে আমাদের উপর হামলা করে। হামলায় আমাদের দু’জন মানুষ মারা গেছেন। আমরা চাই গোলাপবাহিনীর বিচার।
জাহানপুরে খুনের ঘটনা ও লুটপাটের বিষয়ে জানতে চাইলে দিরাই থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
দিলেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দোহাই।
এ বিষয়ে জেলা সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) জাকির হোসাইন বলেন, এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত চলছে। পরিস্থিতি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেফতারের আওতায় আনা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও গ্রামছাড়া নারী-শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
দিরাইয়ে প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে গ্রামছাড়া অর্ধশত পরিবার
- আপলোড সময় : ২১-১০-২০২৫ ০৭:৪৮:৩৭ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২১-১০-২০২৫ ০৭:৫৪:০৪ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ